শিশু সাহিত্যের ক্রমবিকাশ

বাংলা শিশুসাহিত্য আর আঁতুড়ঘরে নেই। নেই আর অন্দরেও। ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শিশুসাহিত্য আর শিশুটিও নেই। নামে শিশুসাহিত্য হলেও সে এখন টগবগ করছে গণমানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বলা যেতে পারে, সে এখন অনুশাসন মানে না কারও। বরং শাসক হিসেবেই ধারাবাহিক বাড়ন্ত অবয়ব তার। সময়ের প্রয়োজনেই জীবনকে জীবনের মতো দেখে ‘শিশুসাহিত্য’নামক একদা অবহেলিত এই সাহিত্য এখন জীবনের জয়গান গেয়ে যাচ্ছে অবিরাম।

বাংলা শিশুসাহিত্যের বয়স খুব বেশি নয়। মাত্র দুই-আড়াইশ বছর। রবীন্দ্রনাপূর্ববর্তী যুগে শিশুসাহিত্য ছিল নিছক উপদেশমূলক। এরপর মানববন্দনা আর ধর্মবন্দনা যোগ হয়েছিল। এর মধ্যে থেকেই দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজমুদার,উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং যোগীন্দ্রনাথ সরকার এসে শিশুসাহিত্যে বিপ্লবের জোয়ার বইয়ে দেন। অন্দর ছেড়ে এল শিশুসাহিত্য। আলো-বাতাসের সঙ্গে একাকার হয়ে স্বপ্নময় জগতে পরিণত হল। বুদ্ধদেব বসু সেই স্বপ্নময় জগতের নাম দিলেন‘শিশুসাহিত্যের সোনালি যুগ’ এই সোনালি যুগের আরও কয়েকজন প্রাণপুুরুষ আছেন। তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায় প্রমুখ। আর এখন চলছে শিশুসাহিত্যের আধুনিক যুগ। অনেক ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া পেলেও সেই শত বছর আগের সোনালি যুগের ছায়া এখনও আছে। যা যোগ হয়েছে, তা হল আধুনিকতা।

আগেই বলেছি, বাংলা শিশুসাহিত্যের বয়স খুব বেশি নয়। মাত্র ২৫০ বছরের কিছু বেশি। এত কম বয়সেও শিশুসাহিত্যের বিস্ময়কর বিস্তৃতি, প্রভাব এবং ধারাবাহিক পালাবদলের কথা বলতে গেলে সবার আগে চোখের সামনে ভেসে ওঠে শিশুপযোগী নানা পত্রপত্রিকার কথা। বাংলাদেশের বা বাংলারÑ যাই বলি না কেন, শিশুসাহিত্যের উন্নতির মূলে ছোটদের উপযোগী সাময়িক পত্রপত্রিকার অবদান যে অনেক তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

শিশুসাহিত্য গঠনের নানা উপাদান প্রথম থেকেই ছড়িয়ে দিয়ে আসছে সাময়িক পত্রপত্রিকাগুলো। পাশাপাশি শিশুসাহিত্যের প্রচার,প্রসার এবং উন্নতির ধারাবাহিকতা এসেছে এসব পত্রপত্রিকা দিয়ে। এই কথাটা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এসব সাময়িক পত্রপত্রিকা শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারকে যথেষ্ট হৃষ্টপুষ্ট করেছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে শিশুসাহিত্যকে সাবালক করে তুলেছে।

শুরুতে একটু হতাশা প্রকাশ করে বলতে হয়, বাংলা শিশু সাময়িকপত্রের ইতিহাস দুঃখ ও নৈরাশ্যের গভীরে সবসময়ই হাবুডুবু খেয়েছে। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত ‘দিগ্দর্শন’ পত্রিকা থেকে শুরু করে সর্বশেষ মাসিক মুকুল পর্যন্ত আলোচিত হয়েছে ইতোপূর্বে।

সে আলোচনা থেকে যে নির্যাস আমরা পেয়েছি তা খুব সুখকর নয়। তৎকালীন পুরো বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে শিশু মৃত্যুহারের মতো সাময়িকপত্রের মৃত্যুহারও সমানতালে এগিয়েছে। গত সোয়াশ’ বছরের ইতিহাসে পুরো বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে দুই শতাধিক পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে অল্প কয়েকটি ছাড়া কোনোটি আর টিকে নেই। যে কয়টি সাময়িক পত্রপত্রিকা দীর্ঘ সময় ধরে টিকে আছে তা আমাদের বাংলাদেশের নয়। প্রতিটি সাময়িকপত্রই পশ্চিম বাংলার। এরমধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে সন্দেশ, শুকতারা, কিশোর ভারতী, ময়ুরপঙ্খী।

এসব পত্রপত্রিকা ছাড়াও কয়েকটি বার্ষিক, ষান্মাসিক, ত্রৈমাসিক,মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিকের কথা ইতোমধ্যে উল্লেখিত হয়েছে। উল্লেখিত হয়েছে ইতিহাসের প্রথম শিশুবার্ষিকী পার্বণী, রংমশাল,শিশুসাথী-সহ বেশকিছু সংকলনের কথা।

কিন্তু সেই আগের দিন আর নেই। শিশুসাহিত্য সোনালি যুগ পেরিয়ে এখন অতিক্রম করেছে আধুনিক যুগ। এখন শিশুরা অনেক বেশি জ্ঞান-উন্মুখ হয়ে পড়েছে। তারা খুব সহজে পৃথিবীর প্রান্তবদল করতে চায়। পৃথিবী নামের এই গ্রহটির নানা প্রান্ত থেকে সাহিত্যরস বের করে আনার যে উপকরণ,পত্রপত্রিকাÑ তার দিকে নজর বেড়েছে। এই বাড়ন্ত নজরের কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পত্রপত্রিকার পাশাপাশি নানা শিশুবার্ষিকীও।

বর্ষাবিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে সুনীল আকাশে যখন টুকরো টুকরো সাদা সাদা মেঘ ঘুরে বেড়ায়, আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজের প্রান্তরে যখন দুলতে থাকে কাশের বাগান, সন্ধ্যার পর এবাড়ি ওবাড়ি থেকে ভেসে আসে শিউলির সুবাসÑ তখন নতুন কিছু শিশুবার্ষিকীর গন্ধ যেন নাকে আসে। পশ্চিম বাংলা থেকে বেশকিছু শিশুবার্ষিকী নিয়মিত প্রকাশ করা হয়। এসব শিশুবার্ষিকী ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি আমাদের দেশেও এসে যায়।

নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে এমন যেসব শিশুবার্ষিকীর কথা উল্লেখ করেছি তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হল আনন্দমেলা। এই সব শিশুবার্ষিকীর কারণে বা বলা যায় প্রয়োজনে যেসব বিশিষ্ট লেখক, কবি- সাহিত্যিক শুধু বড়দের কাগজে গল্প-উপন্যাস লিখতেন তারাও ছুটে এসেছেন শিশুর মনস্তত্ব জগতকে আলোকিত করতে। সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু, সমরেশ মজুমদারের অর্জুনের পাশাপাশি আরও বেশকিছু চরিত্র শিশুদের সামনে এসে যায়। তার মধ্যে আছে গোগোল, কিকিয়া, রিজুদার মতন জনপ্রিয় চরিত্র। শিশুরা স্বপ্ন দেখতে লাগল। তারা পুলকিত হয়ে উঠল স্ট্রাইকার, স্টপার,কোনি, গোসাই বাগানের ভূত, রতন পড়ে।

প্রমাণিত হয়েছে সমরেশ মজুমদার, সমরেশ বসু, বিমল কর,বুদ্ধদেব গুহ, কার্তিক ঘোষ, শীর্ষেন্দু চট্টোপাধ্যায়েরা নিজেদের জগতের পাশাপাশি ছোটদের জগতটাকে সমান বোঝেন।

সেই হিসেবে আমাদের দেশে শিশুবার্ষিকী নেহায়েত কম। কিন্তু পত্রপত্রিকাÑ বিশেষ করে কিছু মাসিক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ছোটদের হাতে তুলে দেন বেশ কয়েকজন গুণী মানুষ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন আবদুল্লাহ আল মূতী শরফুদ্দীন।

এখানে এই কথাটিও উল্লেখ করতে হয় যে, সাতচল্লিশ পরবর্তী বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা তাদের মনের মতন কাগজ বাছাই করার সুযোগ পেয়ে যায়। এসব পত্রিকা এসে যায় তাদের হাতের নাগালে। সেই সময় কোনো দৈনিক পত্রপত্রিকায় শিশু বিভাগ না থাকলেও মাসিক পত্রপত্রিকার কারণে লেখার মান ক্রমশই বাড়তে থাকে। স্বাধীন চিন্তা-চেতনার কারণে সাহিত্যের দিকপালদের পাশাপাশি ইতোমধ্যে জুটে গেছে কিশোর-তরুণরাও।

দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় মুকুল ফৌজের মুখপত্র হিসেবে আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিনের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘মুকুল’ নামের পাক্ষিক পত্রিকাটি এ দেশের সাতচল্লিশ-পরবর্তীকালের প্রথম ছোটদের পত্রিকা। সেই থেকে শুরু করে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জনের আগ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ছোটদের পত্রিকার মধ্যে ছিলÑ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা থেকে প্রকাশিত (১০টি সংখ্যা প্রকাশের পর ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দেই বন্ধ) মঈদ-উর রহমান সম্পাদিত মাসিক ‘ঝংকার’,বেগম ফওজিয়া সামাদের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত (দুই বছর চলে ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে বন্ধ) মাসিক ‘মিনার’, ঢাকা থেকে ১৩৫৭ বঙ্গাব্দে ফয়েজ আহমেদের সম্পাদনায় প্রকাশিত ও পৌনে দুই বছর টিকে থাকা মাসিক ‘হুল্লোড়’, এপ্রিল-মে, ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তৈয়েবুর রহমানের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত (মোট চারটি সংখ্যা বেরিয়েছিল) মাসিক ‘সবুজ নিশান’, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে ঢাকা থেকে আবদুল ওয়াহেদের সম্পাদনায় প্রকাশিত (আট বছর টিকে ছিল) মাসিক ‘আলাপনী’, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চ থেকে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই পর্যন্ত টিকে থাকা সরদার জয়েনউদ্দীন সম্পাদিত পাক্ষিক ‘সেতারা’ ও একই রকমের আয়ুষ্কালের একই সম্পাদকের সম্পাদনায় একই সময় পর্বে প্রকাশিত পাক্ষিক ‘শাহীন’, আল কামাল আবদুল ওহাবের সম্পাদনায় সবুজ সেনার মুখপত্র হিসেবে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত (১১টি সংখ্যা বেরিয়েছিল) মাসিক ‘সবুজ সেনা’,১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে জেব-উন নিসা আহমদ সম্পাদিত (আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রকাশিত) মাসিক ‘খেলাঘর’,অধ্যাপক আলমগীর জলিল ও আলাউদ্দিন আল আজাদ সম্পাদিত ১৩৬৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত পাক্ষিক ‘কিশলয়’, ১৩৬৭ থেকে ১৩৭৪ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ঢাকা থেকে প্রকাশিত মোসলেম উদ্দিন সম্পাদিত মাসিক ‘রংধুন’।

পুরো পঞ্চাশ দশক ধরে এসব পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যারা শিশুসাহিত্য উজ্জ্বলতর করেছেন তারা হচ্ছেন, আবদুল্লাহ আল-মুতি, বন্দে আলী মিয়া, সাজেদুল করিম, ফয়েজ আহমদ,রোকনুজ্জামান খান, সুফিয়া কামাল, হাসান জান, মনোমোহন বর্মণ-মোহাম্মদ নাসির আলী, হালিমা খাতুন, কাজী লতিফা হক, আবদার রশীদ, জসীম উদ্দীন, আতোয়ার রহমান, হাবীবুর রহমান, কাজী কাদের নওয়াজ, আল কামাল আবদুল ওহাব, আহসান হাবীব,সানাউল হক, আবদুস সাত্তার, মোস্তফা কামাল, অনির্কাণ মিত্র,লুৎফর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সরদার জয়েনউদ্দীন,ফররুখ আহমেদ, মোহাম্মদ মোদাব্বে­ হোসনে আরা, শহীদ সাবের,তবিবুর রহমান, আবুল হোসেন মিয়া, কাজী আবুল কাশেম, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন, তালিম হোসেন এদের অনেকেই মূলত বড়দের জন্য লিখলেও, উপরে উল্লেখিত পত্রপত্রিকার প্রয়োজনে ছোটদের জন্য লেখায়ও মনোনিবেশ করেন।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুজন হচ্ছেন কবি ফররুখ আহমদ এবং কবি আহসান হাবীব।

কবি ফররুখ আহমদ ইসলামি রেনেসাঁর অন্যতম প্রবক্ত হিসেবে সাহিত্য রচনা করে এবং এগিয়ে আসা প্রগতিশীলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। কিন্তু শিশুসাহিত্য রচনায় বিশেষ করে কবিতা-ছড়ার মাধ্যমে তিনি তার শক্তি ও ঔজ্জ্বল্যের প্রকাশ ঘটান। তার দু-একটি নমুনা তুলে ধরছি।

ঝুমকো জবা

ঝুমকো জবা বনের দুল

উঠল ফুটে বনের ফুল।

সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে,

ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে।

সেই দুলুনির তালে তালে,

মন উড়ে যায় ডালে ডালে।

বৃষ্টির ছড়া

বৃষ্টি এল কাশ বনে

জাগল সাড়া ঘাস বনে,

বকের সারি কোথা রে

লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।

নদীতে নাই খেয়া যে,

ডাকল দূরে দেয়া যে,

কোন সে বনের আড়ালে

ফুটল আবার কেয়া যে।

পাশাপাশি আহসান হাবীব ছিলেন সাহিত্যে প্রগতিশীলতার অন্যতম সৈনিক। এ সময় তার কয়েকটি শিশুতোষ কবিতা নতুন স্বপ্নে বিভোর করে তোলে শিশুদের। তার এসব কবিতায় প্রগতি ও আধুনিকতার পাশাপাশি শিশুদের জন্য তৈরি করেন এক স্বপ্নরাজ্য। স্বপ্ন ময় এসব কবিতার ভাষাও শিল্পশৈলীর কারণে যেন নতুন প্রাণ পায় ছোটদের কবিতা। শিশুসাহিত্যের ক্রমবিকাশে এ যেন এক নতুন ধারা। প্রায় পৌনে একশ বছরের রবীন্দ্র ধারার পরিবর্তনও হয় এখানে। তিনি লিখেছেনÑ

তারা একটি দুটি তিনটি করে এল

তখন বৃষ্টিভেজা শীতের হাওয়া

বইছে এলোমেলো,

তারা একটি দুটি তিনটি করে এল।

থইথইথই অন্ধকারে

ঝাউয়ের শাখা দোলে

সেই অন্ধকারে শনশনশন

আওয়াজ শুধু তোলে।

……………………..

তখন থমকে দাঁড়ায় শীতের হাওয়া

চমকে গিয়ে বলে-

খুশি খুশি মুখটি নিয়ে

তোমরা এলে কারা?

তোমরা কি ভাই নীল আকাশের তারা ?

আলোর পাখি নাম জোনাকি

জাগি রাতের বেলা,

নিজকে জ্বেলে এই আমাদের

ভালোবাসার খেলা।

তারা নইকো- নইকো তারা

নই আকাশের চাঁদ

ছোট বুকে আছে শুধুই

ভালোবাসার সাধ।

এখানে আবদুল্লাহ আল মুতীর কথা না বললেই নয়, তিনি নিজেই দিলেন শিক্ষাব্রতী ও বিজ্ঞানের লেখক। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানকে সহজ ও সাবলীল ভাষায় লিখে ছোটদের মাঝে ছড়িয়ে দেন। বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়কে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে ছোটদের কাছে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিনের রয়েছে বিশাল অবদান। শিশুদের উন্নত চরিত্রের অধিকারী হিসেবে সড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। শুধু তাই নয় নব্বই দশকে পর্যন্ত তার দীর্ঘজীবনে তিনি বিজ্ঞানকে আধুনিক ও জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখেন।

একজন চিন্তাশীল মানুষের কথা না বললেই নয়। তিনি সাজেদুল করিম। ছোটদের জন্য হাসির গল্প লিখেছেন প্রচুর। তার গল্পে আছে হাসির পাশাপাশি শিক্ষণীয় নানা বিষয়-আশয়। সাজেদুল করিমের প্রথম বই ‘চিংড়ি ফড়িং-এর জন্মদিনে’র অধিকাংশ লেখা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। তার অনবদ্র্য আরও তিনটি বই হচ্ছেÑ‘দস্যি ছেলের দশ চক্রে’, ‘চেরাপুঞ্জি পলিটিক্স’ এবং ‘মাসিপিশির অ্যালজেব্রা’।

ছোটদের জন্য কম লিখেও কেবল লেখার গুনে যে দুজন মানুষ বেশ জনপ্রিয়তা পান তারা হলেন রোকনুজ্জামান খান এবং আশরাফ সিদ্দিকী। রোকনুজ্জামান খান হাস্যরস কবিতার, বিশেষ করে ‘গাধার কান’ ‘হাসি’ কবিতার পাশাপাশি ‘বাকবাকুম পায়রা’র মতো শিশুতোষ কবিতা লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। আর আশরাফ সিদ্দিকীর কবিতা ‘সিন্দাবাদের মতো’ শিশুদের অ্যাডভেঞ্চার মনকে উস্কে দিয়েছিল।

ছোটদের জন্য প্রচুর ছড়া ও গদ্য লিখেছেন ফয়েজ আহমদ। সুকুমারীয় উদ্ভট খেয়াল খুশির পাশাপাশি তিনি ছোটদের মাঝে ছড়িয়ে দেন দেশাত্মবোধ এবং প্রতিবাদের সুর।

বড়দের লেখক হয়েও গদ্যে-পদ্যে শিশুসাহিত্যের সোনালি সম্পদ গড়ে তোলেন সুফিয়া কামাল, জসীম উদ্দীন, সানাউল হক এবং আলাউদ্দীন আল আজাদও। এর মধ্যে আলাউদ্দীন আল আজাদ ছোটদের জন্য কম লিখলেও তার গল্প ‘গলির ধারের ছেলেটি’আবেগে আপ্লুত করেছিল শিশুসাহিত্যের পাঠকদের। কবি সুফিয়া কামালের ‘পল্লীস্মৃতি’ এবং ‘আজিকার শিশু’ চিরায়ত সাহিত্যে পরিণত হয়েছে ইতোমধ্যে।

শিশুসাহিত্যে হাবীবুর রহমান একটি উল্লেখযোগ্য নাম। গল্প-উপন্যাস-রূপকথা ও ছোটদের কবিতা রচনায় তিনি এক ভিন্নধারার লেখক। বিষয় ও আঙ্গিককে তিনি আধুনিকতায় রূপ দেওয়ায় পাশাপাশি ছোটদের পরিবেশ সচেতন করার ব্রত গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে তার ‘বনমোরগের বাসা’ এবং ‘লেজ দিয়ে যায় কেনা’ বই দুটির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

কাজী কাদের নওয়াজও মূলত কবি। ছোটদের জন্যও তিনি বেশকিছু কবিতা লেখেন। খুব বেশি পরিবর্তনের ছোঁয়া না থাকলেও তার ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উপদেশমূলক কবিতা হিসেবে এই কবিতা চিরন্তনিতে স্থান পায়।

ষাটের দশকের শুরুতে শিশুসাহিত্যের শরীরে আরও বেশকিছু ঝলমলে পালক গজায়। বড়দের জন্য মূলত লেখেন এমন কয়েকটি নামের পাশে ইতোমধ্যে যুক্ত হয়েছেন বেশকিছু লেখক। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম না বললেই নয়। তারা হলেনÑঅরুণাভ সরকার, শামসুল ইসলাম, রফিকুন নবী, হায়াৎ মামুদ, আল মাহমুদ, এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ, সৈয়দ শামসুল হক,সুকুমার বড়–য়া, দিলওয়ার, মোহাম্মদ মোস্তফা, মাহবুব তালুকদার,কাইয়ুম চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্, আমজাদ হোসেন, আসাদ চৌধুরী। পাশাপাশি কয়েক তরুণের আবির্ভাবও ঘটে এ সময়। তাদের মধ্যে উল্লেখ করার মতো কয়েকজন হলেনÑ মাহবুব সাদিক, আলী ইমাম, আখতার হুসেন, কাইজার চৌধুরী, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, মাহমুদ উল্লাহ,খালেক বিন জয়েনউদদীন, মসউদ-উশ শহীদ, প্রবণ চৌধুরী, কাজী রাশিদা আনওয়ার আবু সালেহ, দীপঙ্কর চক্রবর্তী।

এর আগে শিশুসাহিত্যের স্বর্ণযুগ পেরিয়ে এলেও ছোটদের পত্রপত্রিকার স্বর্ণযুগ আসে মূলত গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। এই সময় পশ্চিম বাংলা থেকে চোখ ধাঁধানো এক কাণ্ড ঘটায় সত্যজিত রায়-সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সন্দেশ’। বলা যেতে পারে প্রকাশনা সৌকর্যের শুরু এখান থেকেই। সত্যজিত রায়ের শৈল্পিক হাত স্বপ্নময় করে তুলল বাংলার কিশোর-তরুণদের। এ সময় আমাদের এই বাংলাও আর পিছিয়ে থাকে না। একটু ব্যাখ্যা দিয়ে বলি।

ষাটের দশকের আরেকটি কারণে বর্ণময় হয়ে থাকবে। এসময় বেশকিছু পত্রপত্রিকার ছাপা দুটি মাসিক ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। এ দুটি মাসিক হচ্ছেÑ ১৯৬৪ সালে প্রথম প্রকাশিত রোকনুজ্জামান খানের মাসিক ‘কচি ওকাঁচা’ এবং ১৯৬৬ সাল থেকে প্রকাশিত এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদের টাপুর টুপুর।

১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার মুখপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ঝলমলে শিশুমাসিক ‘কচি ও কাঁচা’।রোকনুজ্জামান খানের দক্ষ সম্পাদনার গুণে পত্রিকাটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন হাশেম খান, মাহবুব তালুকদার, শামসুজ্জামান খান, শাহাদৎ চৌধুরী। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে শিল্পী হাশেম খান অপূর্ব ব্যাঞ্জনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।

সম্পাদক রোকনুজ্জামান খান চেয়েছিলেন শিশুমনস্ক বরেণ্য কতিপয় ব্যক্তিত্বের সম্মিলন ঘটিয়ে পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত করা এবং সকলের সমবেত মেধা ও শ্রম কাজে লাগিয়ে কাগজটিকে আকর্ষণীয় করে তোলা। নিঃসন্দেহে বলা যায় ‘কচি ও কাঁচা’-র প্রকাশনা ছিল বাংলাদেশের ছোটদের আধুনিকধারার পত্রিকার ইতিহাসে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আপন মহিমায় দীপ্ত।

‘কচি ও কাঁচা’ প্রথম সংখ্যার লেখক ছিলেনÑ সুফিয়া কামাল,মোহাম্মদ নাসির আলী, আহসান হাবীব, আব্দুল্লাহ আল মুতী, ফয়েজ আহমদ, এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ, শাহ ফজলুর রহমান, কাজী লতিফা হক, সৈয়দ শফিকুল হোসেন, আবুল ওমরাহ মুহম্মদ ফখরুদ্দীন, আবু আলম, হাসান জান, সুকুমার বড়–য়া, আবুল হোসেন মিয়া, ভূঁইয়া ইকবাল, সিদ্দিকা মাহমুদা, লায়লা আজুমান্দ বানু, জাহানারা খাতুন এবং আলী ইমাম। পত্রিকাটির সুন্দর অঙ্গসজ্জা করতেন হাশেম খান, রফিকুন নবী, প্রাণেশ মণ্ডল, আবুল বারক আলভী।

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদের সম্পাদনায় প্রকাশিত‘টাপুর-টুপুর’ এক স্মরণীয় অধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের শিশুসাহিত্যকে এই পত্রিকা বর্ণোজ্জ্বল করেছে। মুদ্রণ পরিপাট্যে,নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় পত্রিকাটি ছিল সৌকর্যমণ্ডিত। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল আধুনিকতা।

আমাদের জাতীয় জীবনে শিল্পÑসাহিত্য ক্ষেত্রে যে জাগরণ আমরা দেখেছি তার একটি পথিকৃৎ পথ নির্দেশক হিসেবে ‘টাপুর-টুপুর’-এর ভূমিকা স্মরণযোগ্য। এই পত্রিকার লেখক তালিকায় ছিলেনÑজসীম উদদীন, আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন, অজিত কুমার গুহ, শামসুর রাহমান, আফলাতুন, সৈয়দ শামসুল হক,সুকুমার বড়–য়া, মাহবুব তালুকদার, মমতাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল কাদির, আনিসুজ্জামান, করুণাময় গোস্বামী, শওকত আলী, গোলাম সামদানী কোরায়শী, আখতার হুসেন, এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ, নিয়ামত হোসেন, নূরুল আনোয়ার, দিলওয়ার, মোস্তফা হারুন, হালিমা খাতুন,সাজেদুল করিম, সুব্রত বড়–য়া, রনেশ দাশগুপ্ত, মুর্তজা বশীর,বুলবন ওসমান, আবু বকর সিদ্দিক, দ্বিজেন শর্মা, ফজল শাহাবুদ্দীন,আনিস চৌধুরী, হায়াৎ মামুদ, ফররুখ আহমদ, সিকান্দার আবু জাফর, লায়লা সামাদ প্রমুখ।

পত্রিকার রচনা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্পাদকের প্রগতিশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায়। শামসুর রাহমানের সুবিখ্যাত ‘আসাদের শার্ট’ কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। ঊনসত্তরের দুর্বার গণ-আন্দোলনের অন্যতম নায়ক শহীদ আসাদ-কে নিয়ে মাহবুবউল্লাহর নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। আহমেদ হুমায়ূন ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘লাল তারিখ’। অজিত কুমার গুহ লিখেছিলেন ‘কালো ব্যাজ’।

শামসুর রাহমানের অনবদ্য, গীতল ভাষায় রচিত স্মৃতিকথা‘স্মৃতির শহর’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। আল মাহমুদ-এর বিখ্যাত কবিতা ‘নোলক’ প্রকাশিত হয়েছিল। ‘টাপুর-টুপুর’ এর বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত আল মাহমুদ-এর ছড়া, কবিতা বাংলা শিশুসাহিত্যে সম্পূর্ণ এক নতুন তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে। শব্দের কারুকাজে, উপমায়, চিত্রকল্পে সেসব রচনা অন্যতম সম্পদ হয়ে উঠল।

বাংলা শিশুসাহিত্যকে সোনালি ফসলে সমৃদ্ধ করছিল ‘টাপুর-টুপুর’-এর রচনাসমূহ। বুলবন ওসমানের ধারাবাহিক উপন্যাস‘ঐরাবত’, মুনীর চৌধুরীর নাটিকা ‘কুপোকাত’, শওকত আলীর গল্প‘রাজা’, শওকত ওসমানের গল্প ‘বাঘের চেয়ে হিংস্র’ সৈয়দ শামসুল হকের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘সীমান্তের সিংহাসন’ ছিল এর নিদর্শন। রবীন্দ্রনাথকে পত্রিকায় নানাভাবে শিশুদের কাছে উপস্থাপিত করা হয়েছে। যাতে তারা রবীন্দ্র-সৃষ্টির বিস্ময়কর ভুবনের সঙ্গে পরিচিত হয়।

এই দশকে আরও বেশ কয়েকটি সংকলন প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে রাজশাহী থেকে হাবীবুর রহমান সম্পাদিত মাসিক ‘পাপড়ি’, শাহেদ আলীর সম্পাদনায় ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত (এখনও প্রকাশনা অব্যাহত) মাসিক ‘সবুজ পাতা’, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে বগুড়া থেকে তাছির উদ্দিন আহমদ ও সেয়দ তাইফুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘সোনারকাঠি’, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের মে পর্যন্ত শামিম আজাদের সম্পাদনায় সিলেট থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘নবারুণ’, ১৩৭১ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে ঢাকা থেকে মো. আবদুল কাদেরের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘টরেটক্কা’, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘কচি ও কাঁচা’, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে ঢাকা থেকে প্রকাশিত (১৯৬৫-তে বন্ধ) গোলাম মোরশেদ ও নীলুফার বানু সম্পাদিত মাসিক ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম থেকে এখ্লাস উদ্দিন আহ্মদ সম্পাদিত মাসিক ‘টাপুর টুপুর’, ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে আবদুস সাত্তারের সম্পাদনায় প্রকাশিত অদ্যাবধি টিকে থাকা মাসিক ‘নবারুণ’ প্রভৃতি এগুলোর মধ্যে নানা কারণে বিশেষভাবে উজ্জ্বল পত্রিকাকে স্মরণ করা যায়।

শিশুসাহিত্যের রুচি নিয়ে একটু কথা বলা দরকার মনে করি। শিশুসাহিত্য তো শিশুরা রচনা করে না, করে বড়রা-ই। প্রায়শ দেখা যায়, যারা শিশুদের জন্য রচনা সৃষ্টি করেন, তাদের মধ্যে নেই কোনো শিশুসুলভ মানসিকতা। লেখকের বয়স, অভিজ্ঞতা এবং রুচিই চালিয়ে দেওয়া হয় শিশুদের মধ্যে। এই মানসিকতার কারণে গত আড়াইশ’ বছর ধরে যা রচিত হয়েছে তা শুধু শিশু নয়, কিশোর-কিশোরীর পক্ষে ও অনুপযুক্ত।

কিন্তু একথাও বলে রাখা ভালো, বিশ্বের কোনো সত্যিই কোনোদিন শিশুদের কথা ভেবে লেখা হয়নি। সব বয়সের মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য এসব লিখেছেন বলে মনে করি। তাহলে এসব কেন শিশুপাঠ্য হয়ে গেল?

এর জন্য দায়ী মূলত অভিভাবকরা। তারাই নানাভাবে শিশুদের মধ্যে জ্যাঠামি ঢুকিয়ে দেন। দেখা যার, যে বয়সে ইউরোপের মেয়েরা ছেলেখেলায় মত থাকে, সে বয়সে আমাদের মেয়েরা সন্তানদের মানুষ করার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেয়।

প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় বলিÑ

“ছেলে যাতে শীঘ্র মানুষ হয়, সেই উদ্দেশ্যে আমরা শৈশবের মেয়াদ পাঁচ বছরের বেশি দেইনে। আজকাল আবার দেখতে পাই অনেকে তার মধ্যেও দুবছর কেটে নেবার পক্ষপাতী। শৈশবটা হচ্ছে মানবজীবনে পন্ডিত জমি; এবং আমাদের বিশ্বাস, এই পতিতজমি যত শীঘ্র আবাদ করা যাবে তাতে তত বেশি সোনা ফলবে।

‘বাবা-মা’র এই সুবর্ণের লোভবশত এদেশের ছেলেদের বর্ণপরিচয়টা অতি শৈশবেই হয়ে থাকে। এ কালের শিক্ষিত লোকেরা লোকেরা ছেলে ছেলে হাঁটতে শিখলেই তাকে পড়তে বসান। শিশুদের উপর এরূপ অত্যাচার করাটা যে ভবিষ্যৎ বাঙালিজাতির পক্ষের কল্যাণকর নয়। সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই; কেননা যে শৈশবে শিশু ছিল না, সে যৌবনে যুবক হতে পারবে না। আর এ কথা বলা বাহুল্য শিশুশিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে শিশুর শিশুত্ব নষ্ট করা; অর্থাৎ আনন্দ উপভোগ করবার শক্তি অপরিমিত, তাকে জ্ঞানে ভোগ ভোগানো।”

আবার রুচির প্রশ্নে আসি, একসময় শিশুদের জন্য রচিত হত কেবল উপদেশ ধর্মী লেখা। এসব লেখা…..শিশুদের অনিহা ছিল প্রবল। বড়রা একবারও ভাবত না, উপদেশ শিশুদের একমাত্র প্রাপ্য হতে পারে না। এটি স্কুলে শিশুশিক্ষার বিষয় হতে পারে।

শিশুসাহিত্য রচনায় বড়রা ঠিক কাজটিই করেছিলেন। স্কুলশিক্ষার বইয়ে যেসব বিশ্বরস বাদ পড়ে যায় তা জোগান দেয় সাহিত্য। বসলেই তো আর সাহিত্য রচনা হয়ে যায় না। রূপকথা,লোককথা, উপকথা, ডন কুইকসেট, গালিভার্স ট্রাভেলস, রবিনসন ক্রোসো, হ্যান্স ব্যাক অব নোতরদেম, রবিন হুড-এসব রচনার সময় শিশু কিংবা বালক-বালিকার কথা হয়তো ভাবা হয়েছিল,কিন্তু এসব লেখা বড়দের হয়ে উঠেছিল। তাতে দমে যায়নি শিশুরা কিংবা বালক-বালিকারা তারা উপদেশের বেত্রাঘাত থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষে আত্মসাৎ করে এসব। এমনকী রামায়ণ-মহাভারত, আরব্য উপন্যাস, পারস্য উপন্যাস পর্যন্ত দখলে নিয়ে নেয়।

শিশুদের রুচির এই পরির্বতনের প্রধান কারণ, তাদের চাহিদামতো সাহিত্য রচিত হয়নি।

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে প্রায় অর্ধশত বছর শিশুসাহিত্যের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর সুকুমার রায়,যোগীন্দ্রনাথ সরকার, সুখলতা রাও, লীলা মজুমদাররা শিশুসাহিত্যের ধারণাই পাল্টে দেয়। এই উজ্জ্বল যুগের আদিপুরুষ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এরপর কী হল! ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আমূল পরিবর্তন হতে থাকে দেশভাগের পর। বলা যেতে পারে শিশুসাহিত্য প্রবেশ করল আধুনিক যুগে।

শিশুসাহিত্যের আধুনিক যুগে প্রবেশের প্রধান হাতিয়ার ছিল ছোটদের জন্য প্রকাশিত কিছু আলোকোজ্জ্বল সংকলন। ইতোমধ্যে আলোচিত এসব সংকলনের কারণে যারা বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যকে আধুনিকতার খোলা জানালার কাছে নিয়ে যান তাঁরা হলেনÑ সুফিয়া কামাল, আবদুল্লাহ আল-মুতী, হাবীবুর রহমান, কাজী কাদের নওয়াজ, আহসান হাবীব, এ কে বজলুল করিম, আল কামাল আবদুল ওহাব, আতোয়ার রহমান, সাজেদুল করিম, মোহাম্মদ নাসির আলী, রোকনুজ্জামান খান, ফয়েজ আহমদ,ফররুখ আহমদ, মোহাম্মদ মোদাব্বের, সানাউল হক, হোসেন আরা প্রমুখ।

ছোটদের শুধু আনন্দ দেওয়া-ই মুখ্য নয়, ছোটদের মাঝে কীভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে চেতনা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, বিশ্বচরাচরের বিশাল ভান্ডারকে জড়ো করে ছোটদের সামনে হাজির করানো যায় তার চেষ্টাও চলল।

কিছু লেখা আছে, যা পড়লে বুকের ভেতরে হু-হু করে ঝড় বয়ে যায়। মনের গহিনে ছড়িয়ে যায় শারদসন্ধ্যার উদাসী বাতাস। যেন এক হিমেল কাঁপুনি। আমরা ছোটদের সেই জগৎ খুঁজে বেড়াই সারাক্ষণ। শুরুতেই তো বলেছি, শিশুরা আর সেই শিশুটি নেই। অবনীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যেতে পারে, ‘শিশুজগৎটা বুড়িয়ে গেল নাকি!’ তারা ঘরের কোণে বসে শৈশববিজ্ঞানের বই পড়ছে, কাছে এগোয় না ঠাকুরদাদার রামায়ণকথা শুনতে।

আর আমাদের কালে কী দেখছি! অবনবুড়োর কথাই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বিজ্ঞানের এমন বেমালুম সত্য কথা অত আগে তিনি যখন বুঝতে পেরেছিলেন, তখন আমরাও বুঝতে পারি, বইয়ের বস্তা কাঁধে বয়ে বেড়ালে শিশুরা আর শিশু থাকে না। অবনবুড়োর ‘বুড়িয়ে যাওয়া-’কে ঘুরিয়ে বলতে পারি রোবট-টোবটজাতীয় কিছু একটা হয়ে যাচ্ছে তারা। অবশ্য তাতে কিছু যায়-আসে না কোন লেখকের, স্রষ্টার বা নির্মাতার।

ষাটের দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সমান জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন অনেকেই।

বিশেষ করে মূলত বড়দের জন্য বেশি লিখেও কিংবা ঘুরিয়ে বলা যায় শিশুসাহিত্য তুলনামূলকভাবে কম রচনা করেও উজ্জ্বলের সাক্ষর রেখেছেনÑসৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, দিলওয়ার,অরুণাভ সরকার, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এবং আসাদ চৌধুরী।

সৈয়দ শামসুল হক তার ছোটদের কবিতার আধুনিকতাকে বেশ শক্তপোক্ত করে ধরে রেখেছেন। আল মাহমুদের বেশকিছু কিশোর কবিতার পাশাপাশি ঊনসত্তরের ছড়া লিখে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্র ‘সাতনরী হার’ আসাদ চৌধুরীর‘এক্কাদোক্কা’ অরুণাভ সরকারের ‘খোকনের অভিযান’ বিশেষভাবে উল্লেখর দাবি রাখে। ছোটদের জন্য লেখা কবিতা-ছড়ার পাশা গল্প-উপন্যাস নিজেদের সুনাম অক্ষুণœ রেখেছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং অরুণাভ সরকার।

পাশাপাশি শিশুসাহিত্য নিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন কাজ করে যাচ্ছেন আমজাদ হোসেন। কিশোর কবিতার দিকেই তার সবচেয়ে বেশি মনোনিবেশ। তার লেখা ‘জন্মদিনের ক্যামেরা’ ‘যাদুর পায়রা’, ‘ঠান্ডা হিম ভূতের ডিম’ এবং ‘টুকটুক’ সাহত্যিকীর্তি হিসেবে অসামান্য।

‘টাপুর টুপুর’ সম্পাদক এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি লেখালেখি শুরু করলেও তার উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল ষাটের দশকে। গদ্যেপদ্যে সমান পারদর্শী এই লেখক ছড়ার পাশাপাশি স্বপ্নময় গদ্যও রচনা করেন। তার ‘তুনতু বুড়ির ছড়া’, ‘বৈঠকি ছড়া’, ‘বাজাও ঝাঁঝর বাদ্যি’, ‘এক যে ছিল নেংটি’, ‘মাঠপারের গল্প’, বাংলা শিশুসাহিত্যের অমূল্য রতœ। শুধু তা-ই নয়, তার বর্ণময় জীবনের কাহিনিকে কেন্দ্র করে উপন্যাস ‘ফিরে দেখা’ শিশুসাহিত্যকে বেশ সমৃদ্ধই করেছে।

জনপ্রিয়ধারার লেখকদের মধ্যে তিনটি নাম পাঠককে বিমুগ্ধ করে রেখেছে। এর মধ্যে অগ্রগণ্য হয়ে আছেন আলী ইমাম, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং শাহরিয়ার কবির। পাঁচ শতাধিক বইয়ের লেখক আলী ইমাম মূলত দেশজ পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে তার রচনাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার লেখা ‘বনকুসুমপুর রহস্য’, ‘অপারেশন কাঁকনপুর’, ‘দ্বীপের নাম মঠুবুনিয়া’, ‘তিতিরমুখীর চৈতা’, ‘জীবনের জন্য’, ‘সবুজ খাতা’ পাঠকের মনে তুমুল আলোড়ন তুলেছে। রহস্য রোমাঞ্চের পাশাপাশি তিনি শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিকাশেও কাজ করে যাচ্ছেন অবিরাম।

রহস্য রোমাঞ্চের আরেক প্রাণপুরুষ শাহরিয়ার কবির। তার লেখা‘আবুদের অ্যাডভেঞ্চার’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’ কিশোরদের মনকে আলোড়িত করেছিল।

ষাটের দশকের চেয়ে পরবর্তী দশকগুলোতে, এমনকী বর্তমানেও অনেক বেশি উজ্জ্বল মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। মূলত তার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি কিশোরদের রুচির পরিবর্তন করে দিয়েছে। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি কতটুকু মৌলিক এই প্রশ্নকে এড়িয়ে গেলেও তার মৌলিক গল্প-উপন্যাসগুলো সমান জনপ্রিয়। বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখেÑ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘হাতকাটা রবিন’ এবং ‘আমার বন্ধু রাশেদ’।

একই সময়ের, বিশেষ করে এখনও সমান পায়দর্শিতায় ছোটদের জন্য গল্প লিখে বলেছেন কাইজার চৌধুরী। গল্প লেখার চেয়ে গল্প বানানোয় যেন তার প্রধান কাজ। সমাজের সবচেয়ে সিরিয়াস বিষয়কেও হাস্যকর করে তুলতে পারঙ্গম তিনি। সমাজ কীভাবে দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে, কীভাবে মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছেÑ তা তার গল্পের প্রধান উপজীব্য। পাশাপাশি বিলটুমামা, পলটুমামা,ন্যাড়াদের নিয়ে হাসির যে গল্প নির্মাণ করেছেন তার জুড়ি নেই।

ষাটের দশকে কয়েকজন কবি ও ছড়াকারও আলোড়ন তুলেছেন সমানে। তাদের মধ্যে সবার আগে নাম আসে সুকুমার বড়–য়ার নাম। ফয়েজ আহমদের পেছনে হেঁটেও সমাজচিত্র নির্মাণে অনেক বেশি এগিয়ে গেছেন তিনি। শিশুতোষ বিষয়ের পাশাপাশি বড়দের বিষয়কেও নিখুঁতভাবে হাজির করেছেন ছোটদের সামনে। তার প্রতিটি ছড়া পড়ে যেমন আনন্দে আহ্লাদিত হয়েছে শিশুরা, তেমনি ভাবনার সাগরে কেটেছেন বড়রা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আহরিত সমাজের দারিদ্রকেও হাস্যকর করে তুলেছেন তিনি। বলা যেতে পারে ছড়াসাহিত্যের তুলতুলে ভাবকে তিনি সাবালক করে তুলেছেন।

পাশাপাশি রফিকুল হক, আবু সালেহ এবং আখতার হুসেন ছড়ায় দিয়েছেন অফুরন্ত প্রাণশক্তি। একদিকে রফিকুল হক কাব্য ও নিরীক্ষাধর্মী ছড়া লিখেছেন, অন্যদিকে আবু সালেই বিপ্লব ও সংগ্রামের হাতিয়ার বানিয়েছেন ছড়াকে। এ দুজনকে পাশে রেখে আখতার হুসেন নানাবিধ শিশুতোষ এবং কিশোর কবিতা লিখে বাঁকবদলের চেষ্টা করেছেন শিশুসাহিত্যের।

ষাটের দশকের গোড়ার দিক থেকে ছড়া লেখা দিয়ে শুরু মাহবুব সাদিকের। শেষ ষাটে বড়দের কবিতা এবং গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় ছুটি নিয়েছিলেন শিশুসাহিত্য থেকে। অবশ্য সত্তরের মাঝামাঝিতে এসে আবার হাত দেন শিশুসাহিত্যে। ইতোমধ্যে ছোটদের জন্য লেখা তার গল্প ও উপন্যাস কিশোরসাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মুচন করে। তার কল্পনা-প্রতিভার সঙ্গে শিল্পের যোগ সংগঠিত হয়েছে। শিশুসাহিত্যের তার ব্যবহৃত ভাষা নতুন একটি ধারার সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি মনে করি। তার উল্লেখযোগ্য বইÑ‘স্বপ্নের বনে বনে’, ‘আমরা করব জয়’, কাঁকড়াজানের গুপ্তধন, কাকতাড়–য়ার হাসি ইত্যাদি।

শিশুর কাছে আর ভালো লাগে না ঘুমপাড়ানি গান, ঘুমপাড়ানি ছড়া, ঘুমপাড়ানি গল্প। ভালো লাগবেই-বা কেন? কম্পিউটার,ইন্টারনেট, মোবাইল কিংবা ডিজিটাল গেম তাদের মাথার মগজটাকে নরমসরম রাখেনি আর। আগেকার দিনে, আমাদের শিশুবেলায় আমরাও কাটা ঘুড্ডির পেছনে অবিরাম ছুটেছি। মাঠ-বন সব দখলে রেখেছি। তাতেই উত্তেজিত ছিলাম আমরা। এখনকার শিশুদের জন্য এসব স্বপ্ন। বাস্তব হচ্ছে, পুরো পৃথিবীটাই এখন তাদের হাতের মুঠোয়। বিশ্বজগৎ ছেড়ে সৌরজগতেও ঘোরাঘুরি করে অবিরাম। গোবেচারা ভাব কাটিয়ে ওঠার কারণে ওরা এখন সব খবর রাখে। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতির মতো মোটা মোটা জ্ঞানের খবরও এখন তাদের জানা। একসময় প্রচণ্ড বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য সোনামুখি আমগাছের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিল দুর্গা আর অপু, কিন্তু এখন নদীর ভাঙন ঠেকানোর গল্প শুনতে হচ্ছে। না, গল্প শুনছে না তারা, নিজেরাই দেখছে কীভাবে বাড়িঘর ভাঙছে, শহর গড়ছে। গাছের ডাল কেটে চোখের ঘুম আর স্বপ্নকেও ভাঙা হচ্ছে। গহিন বনের নীরবতার পাশাপাশি কীভাবে ঘরসংসার ভাঙে তাও জানে শিশুরা।

সত্তর দশক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের ছোটদের পত্রিকার মধ্যে রয়েছেÑ ঢাকা থেকে ড. মাযহারুল ইসলামের সম্পাদনায় ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘ধান-শালিকের দেশ’, জোবেদা খানমের সম্পাদনায় ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মাসিক ‘শিশু’,মাসুদ আলীর সম্পাদনায় ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মাসিক‘ফুলকুঁড়ি’, ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত প্রকাশিত নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ ও আহমদ জামান চৌধুরী সম্পাদিত বাংলাদেশের একমাত্র ছোটদের সাপ্তাহিক ‘কিশোর বাংলা’,

১৯৭৪ সালে ড. মাযহারুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ‘ধান-শালিকের দেশ’।

১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ ও আহমদ জামান চৌধুরী সম্পাদিত বাংলাদেশের একমাত্র ছোটদের সাপ্তাহিক ‘কিশোর বাংলা’।

১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী থেকে জোবেদা খানমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘শিশু।’

১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে মাসুদ আলীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়‘ফুলকুঁড়ি।’

১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে খুলনা থেকে জ্যোতির্ময় মল্লিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কুটুম পাখি।’

শিশুসাহিত্যের ক্রমবিকাশের ধারায় ছোটদের পত্রপত্রিকা কি ভূমিকা রাখে তার খতিয়ান দিতে গেলে একটু পেছনে যেতে হয়।

ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগের থেকে শুরু করে অনেকের নাম বলতে পারি। কিন্তু শিশুসাহিত্যের আকাশে সৃজনশীলতার ইন্দ্রধনু হিসাবে আমরা তিনজনের নাম সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে পারি। তারা হচ্ছেনÑ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অমিত্রসুদন ভট্টাচার্যের ভাষায়Ñ জীবনকে যিনি জ্ঞানের আলোয় প্রত্যক্ষ করেছেন, সামগ্রিকভাবে জগত সংসারকে নানাদিক থেকে দর্শন করেছেন। তিনিই হতে পারেন প্রকৃত পথসঙ্গী, আনন্দের সহচর, পথ প্রদর্শক। বাল্যকাল থেকে লেখকের মনের মধ্যে জগত ও জীবন সম্পর্কে যে কৌতূহল,জিজ্ঞাসা, আগ্রহ, উৎসাহ, আনন্দ না থাকলে লেখার মধ্যে আনন্দ ঝংকার কোনো সুর তোলে না। রবীন্দ্রনাথের মতন উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন বিবিধ বিদ্যার উপাসক, জ্ঞানসাধক এবং বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। তোমার সৃষ্টরে চাইতে তুমি যে মহত্- এই কথাটি উপেন্দ্রকিশোর সম্পর্কে বলা যায়। বরং তার বোধ ও ব্যক্তিত্বের অস্ফুরন ঘটে তাদের রচনায়, প্রতিভার ইন্দ্রধনু পুটে ওঠে তাদের সফল সৃষ্টিকর্মে। শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোরের আতœপ্রকাশ সখার পাতাতেই। পত্রিকার প্রথম বর্ষ তেকে লেখকের বয়স তখনও কুড়ি পুর্ণ হয়নি। ঠিক সমসাময়িক কালে জোড়াসাকোর টাকুরবাড়ি তেকে প্রকামিত হল জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায়- বালক। এই পত্রিকার প্রধাণ লেকক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন কবির বয়স ২৪। বারক মাত্রৈ এক বছর টিকেছিল। সেই বছরেই রবীন্দ্রনাথ গর্প-উপন্যাস,ছড়া-কবিতা, নাটক, প্রবন্ধসহ নানা কিছু লিখেছিলেন। এক কথায় সখা উপেন্দ্রকিশোরকে এবং বালক রবীন্দ্রনাথকে বাংলা শিশুসাহিত্যের দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

১৮৯৩ সালে ‘সখা’-র পাশাপাশি ‘সাথী’ নামের একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এটির সম্পাদক ছিলেন ভুবনমোহন রায়। এই পত্রিকার সপ্তম সংখ্যায় উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর‘বেচারাম-কেনারাম’ নাটিকা প্রকাশিত হয়, তার ছবিও এঁকেছিলেন তিনি নিজেই। ‘সখা’ এবং ‘সাথী’ ১৮৯৬ সালে ‘সখা ও সাথী’ নামে একত্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এখানেও প্রধান লেখক ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। পরের বছর ‘মুকুল’ পত্রিকাটি বেরুল। এর সম্পাদক ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। এই পত্রিকার প্রধান লেখক হিসেবে আবিভূত হন দুই প্রতিভাধর লেখক রবীন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রকিশোর। বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রকিশোরের শিশুসাহিত্যের উজ্জল লেখগুলো প্রকাশিত হয়েছিল সখঅ, বালক এবং মুকল যুগেই। এরপর সন্দেশের ইতিহাস তো সবার জানা। বিংশ শতাব্দির শুরুতে সবচেয়ে আকষণীয় মাসিক পত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং প্রথম নাম সন্দেশ। যার সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী।

এ আলোচনায় একটি যৌক্তিক কারণ অবশ্যই আছে। এই দীর্ঘপথ অতিক্রম করে পঞ্চাশের দশকে আমাদের এই দেশে আবিভূত হন বেশ কিছু স্বনামধন্য লেখক। অল্প যে কয়েকটি পত্রিকার নাম ইতোপূবে প্রকাশ করেছি সে সব পত্রিকার মাধ্যমে আবিভূত হলেণ মোহম্মদ নাসির আলী, মোহাম্মদ মোদাব্বের, হোসনে আরা, সাজেদুল করিম, সরদার জয়েনউদ্দীন, রোকনুজ্জামান খান, আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন, ফয়েজ আহমদ, হাবীবুর রহমান, এ কে বজলুল করিম, আহসান হাবীব, এখলাস উদ্দীন আহমেদসহ অনেকেই পঞ্চাশের দশকে এঁরা সবাই ছিলেন কিশোর তরুণ। তাঁরা সবাই সম্পাদকও ছিলেন। এ কথা আগেও বলেছি। ষাটের দশকে এসে‘কচি ও কাঁচা’ এবং চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘টাপুর টুপুর’ আরও একঝাঁক তরুণকে শিশু-সাহিত্যের স্বপ্নময় জগতে এনে হাজির করে। একই সময়ে বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ছোটদের পাতাগুলোও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই সময়ে, যারা লেখালেখি শুরু করে বতমান শিশুসাহিত্যের কালজয়ী শিশুসাহিত্যিক পরিণত হয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম হল, সুকুমার বড়–য়া, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুন, আলী ইমাম, আখতার হুসেন, কাইজার চৌধুরী, খালেক বিন জয়েন উদ্দীন, মোহম্মদ মোস্তফাসহ অনেকেই। একই ধারাবহিকতায় সত্তর ও আশির দশকে আবিভূত হয়ে এখনও শিশুসাহিত্য ফুলকি ছড়াচ্ছেন ফারুক নওয়াজ, আসলাম সানি, সুজন বড়ুয়া, লুৎফর রহমান রিটন,ফরিদুর রেজা সাগর, আমীরুল ইসলাম প্রমুখ।

কিন্তু গত নব্বই দশকের পর থেকে এই পর্যন্ত যারা লেখালেখি করতে এসেছেন তাদের কর্মক্ষেত্র অধিকাংশ দৈনিক পত্রিকায় সীমাবদ্ধ। ইতোমধ্যে বেশকিছু পত্রপত্রিকার নাম বলেছি, বলেছি বার্ষিকীর কথাও। নব্বই পরবর্তী তরুণদের লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও বার্ষিকীগুলোতে তাদের উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সম্পাদক ও প্রকাশকদের দৈন্যতা। কিংবা বলা যেতে পারে এখনকার বার্ষিকীগুলো প্রকাশিত হচ্ছে খ্যাতিমান লেখকদের সামনে এনে প্রকাশকদের কিংবা সম্পাদকের অর্থভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করা। এখানে তারুণ্য উপেক্ষিত।